শ্রী রামচন্দ্রের বনবাসে যাওয়ার রহস্য
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমর্ধমস্য তদান্মনং সৃজাম্যহম্।।
যখন এই জগতের সৃষ্টি করা হয়ছে তখন সয়ং শ্রী নারায়ন বলেছিলেন – যখনই ধর্মের পতন এবং অধর্মের উত্থান হয়, তখন আমি নিজেই অবতার রূপে আবির্ভূত হয়ে এই জগতেকে অধর্মের গ্লানি থেকে মুক্ত করব। এবং যারা অসুর প্রকৃতির কাজ করবে তাদের বিনাশ করবো, আর যারা সাধু বা ভালো কাজ করবে তাদেরকে রক্ষা করবো। সে জন্য শ্রী রামচন্দ্র এই পৃথিবীতে রাজা দশরথ এর ঘরে অবতার রূপে আবির্ভূত হয়ে এসেছিলেন । এবং ভক্তদের আহ্বানে মহাশক্তিশালী অসুর রাবণের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা এবং নিজের জীবনের কর্মের মাধ্যমে ধর্ম সংস্থাপন করেন।
শ্রী রামচন্দ্রের লীলা বিলাস
শ্রী রামচন্দ্র এই জগতে আসার একমাত্র কারন ছিল অধর্মের হাত থেকে এই পৃথিবীকে রক্ষা করা। তিনি আমাদের সমাজের বিভিন্ন খারাপ দিকবিবেচনা করে যুগে যুগে অবতার হয়ে আবির্ভূত হন। ত্রেতা যুগে তিনি শ্রী রামচন্দ্রের অবতার রূপ ধারণ করেন। এবং এভাবেই তিনি প্রত্যেক যুগে আমাদের রক্ষা করতে আবির্ভুত হণ। এভাবে প্রায় এগার হাজার বছর এই জগতে প্রতীয়মান ছিলেন। এই জগতে তাঁর প্রত্যেকটি লীলা এবং কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি জগতের সকল পাপ দূর করেন। উনার এই লীলা থেকে চাইলে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। যার প্রতিটি শিক্ষা আমাদের জীবন চলার পথে বিষেশভাবে কার্যকর হবে। বিশেষভাবে তাঁর দয়ামায়া এবং উপদেশ প্রতিটি জীবের জন্য মঙ্গলময় হয়ে উঠবে। শ্রী রামচন্দ্রের মহানুভব চিন্তাধারা কথখানি উতকৃষ্ট তা এই সময় বোঝা যায়, যখন মাতা কৈকেয়ী তাকে আদেশ করেন যে, হে রামচন্দ্র তোমাকে ১৪ বছরের জন্য বনবাস কাটাতে হবে আর ভরত সিংহাসনের দায়িত্ব পালন করবে। এ কথা শোনা মাত্রই শ্রী রামচন্দ্র উদারতার সহিত তার আদেশ পালন করেন। এবং শ্রী রামচন্দ্র বলেন,
“হে মমতাময়ী মাতা, আমি কত সৌভাগ্যবান, আপনি কত স্নেহময়ী। আপনার এই আদেশ আমি মাথাপেতে নিলাম, আপনার প্রত্যেকটি আদেশ আমার কাছে আশির্বাদ স্বরূপ। আপনার এই আশির্বাদের কারনে আমি অনেকটা বছর মুনি-ঋষিদের সঙ্গে কাটাতে পারবো এবং তাদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করতে পারবো। উনাদের মুখশ্রী থেকে হরিকথা শুনতে পারবো এবং উনাদের নিজের হাতে সেবাযত্ন করতে পারবো। উনারা গভীর বনে থাকেন যেখানে কোন দ্বন্দ্বযুদ্ধ নেই, শুধু আনন্দ আর ভালোবাসা।
শ্রী রামচন্দ্র মাতা কৈকেয়ীর আদেশ পলন করার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল মাতা কৈকেয়ী যাতে কোন প্রকার দুঃখ-কষ্ট না পান এবং উনি সবসময় ভালো থাকেন। আর তিনি চিন্তা করলেন পিতা মাতার আদেশ পালন করাটাই তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। তিনি চিন্তা করলেন অযোধ্যা রাজ্য ছেড়ে বাইরে যাওয়ার এই হচ্ছে সঠিক সময়। আর আমাকে অনেক অসুরদের বধ করে তাদের ধ্বংস করতে হবে এই জগতকে পাপের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। এই চিন্তা করে তিনি মাতা কৈকেয়ীর কাছ থেকে আশীর্বাদ গহণ করলেন। এবং চৌদ্দ বছর বনবাসের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন।
শ্রী রামচন্দ্রের করুনা
বনবাস থাকা কালিন একবার বিভীষণের সাথে শ্রী রামচন্দ্রের সাক্ষাত হয়। এবং শ্রী রামচন্দ্রের অতি মানবীয় মুখশ্রী দেখে বিভীষণ ভক্তি ভরে প্রণাম করেছিলেন এবং শ্রী রামচন্দ্রের সাথে রাবণকে কিভাবে ধ্বংস করবে সে বিষয়ে আলাপ আলোচনা করছিলেন। বিভীষণের এই ন্যায় নীতির ভাবনা দেখে শ্রী রামচন্দ্রের হৃদয়ে তার প্রতি যে সহিস্নুতা দেখালেন তা এই জগতে বিরল। তাই শ্রী রামচন্দ্র বিভীষণকে বললেন “হে বিভীষণ, তুমি যে আমায় এত শ্রদ্ধাভরে সম্মান করলে তার বিনিময়ে আমি তোমায় লঙ্কার রাজা হিসেবে পদার্পন করাবো । আর তোমাকে এই জগতে সত্যবাদী বিভীষণ হিসেবে সৃকৃতি দেবো। ঠিক সেই সময় বানররাজ সুগ্রীব শ্রী রামচন্দ্রকে প্রশ্ন করেন – হে প্রভু, যদি লঙ্কার রাজা রাবণ এসে আপনাকে ভক্তি দিয়ে প্রণাম করে তাহলে আপনি তাকে কি পুরুস্কার প্রদান করবেন? তখন শ্রী রামচন্দ্র হাসতে হাসতে বললেন এখনো যদি রাবণ আমার কাছে তার ভূল স্বীকার করে প্রাণ ভিক্ষা চাই তাহলে আমি তাকে জরিয়ে ধরে তাকে ক্ষমা করে দেবো- আর তাকে এই জগতের শ্রেষ্ঠ ভক্ত হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করবো। এ থেকে বোঝা যায় শ্রী রামচন্দ্র কতটা দয়াবান এবং এই জগতে যা কিছু করেন তা সবার মঙ্গলের জন্য করেন।
অর্থাৎ যিনি শরনাগত মনে ভগবানের শ্রী চরণে আশ্রয় নেন তাকে ভগবান কখনই পরিত্যাগ করতে পারেন না বরং তার জীবনকে উন্নতির উত্তম শিখরে পৌঁছে দেন। একদিন ভ্রমনে গিয়ে ভগবান শ্রী রামচন্দ্রের পায়ে একটা কাঁটা বিধে যায়, সেই কাঁটার বিষে অতি ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সেই সময় সীতা মাতা ‘প্রভুর চরণ হতে কাঁটাটি বের করার চেষ্টা করছিলেন । ঠিক সে সময় ভগবান শ্রী রামচন্দ্রের নিদ্রা ভেঙ্গে গিয়েছিল – তখন ভগবান শ্রী রামচন্দ্র মাতা সীতাকে বললেন, যে আমার চরণে শরনাগত হয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে আমি তাকে কখনই পরিত্যাগ করি না। যদি তা একটি কাঁটাও হয়। এতে বোঝা যায় শ্রী রামচন্দ্রের মনে কোন রাগ নেই। তিনি সবাইকে সরল চিত্তে ভালোবাসেন।
রাবণ যখন সীতা মাতাকে অপহরন করার চেষ্টা করছেন তখন জটায়ু তার জীবনের বিনিময়ে সীতামাতাকে রাবণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি, কিন্তু জটায়ু তার শেষ চেষ্টা করেছিলেন এবং রাবণ তার একটি পাখা কেটে তাকে মৃত্যুদিকে ঠেলে দিলেন আর সীতা মাতাকে নিয়ে চলে গেলন। ঠিক কিছুক্ষণ পর শ্রী রামচন্দ্রের সাথে জটায়ুর দেখা হয়, এবং জটায়ুর মুখ হতে সীতা মাতাকে রাবণ অপহরণের কথা শুনেন। তখন ভগবান শ্রী রামচন্দ্র সীতা মাতার কথা ভুলে গিয়ে এক দৃষ্টিতে জটায়ুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। যখন জটায়ু ‘রাম’ নাম উচ্চারণ করে দেহত্যাগ করেন তখন ভগবান শ্রী রামচন্দ্র অশ্রুশিক্ত নয়নে জটায়ুকে জরিয়ে ধরেন। অবশেষে শ্মশান সর্জিত জটায়ুর দেহকে দাহ করেন এবং তার উদ্দেশ্যে গোদাবরী নদীতে তর্পন ক্রিয়া সম্পন্ন করলেন।
চৌদ্দ বছর পর বনবাস কাটিয়ে শ্রী রামচন্দ্র যখন অযোধ্যায় ফিরে এলেন তখন প্রজাগণ আনন্দে দিশাহারা যেন অনেকদিন পর তাদের কাছে ভগবান ফিরে এলো। এবং শ্রী রামচন্দ্র সকলের এই আনন্দ দেখে নিজের চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি, তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি তাকে তার প্রজাগণ এতই ভালোবাসেন। একদিন খাবার খাওয়ার সময় শ্রী রামচন্দ্র খুব অশ্রুশিক্ত নয়নে কি যেন ভাবতে লাগলেন। তখন তার অনুজেরা সবাই এর কারণ জিজ্ঞাসা করেন, ভগবান শ্রী রামচন্দ্র বললেন, আমার খাওয়ার সময় জটায়ুর কথা এবং সবরীর কথা খুব মনে পড়ে যায়, যারা আমার জন্য এতোকিছু করল তারা আজ আমার পাশে নেই। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। আমি কি করে তাদের ঋণ শোধ করবো। এই সময় অযোধ্যাবাসীগণ জানতে পারলেন যে, যখন প্রভুকে কেউ কোন সেবা করেন এবং বিনম্র চিত্তে তাকে স্বরন করেন। তিনি তাকে কখনো নিরাস করেননা। আর প্রভু রামচন্দ্র তার প্রতি এতটাই ঋণী হন কান্না করেও তার ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না। ভগবান জীবের প্রতি কতযে দয়ালু তা প্রমাণ করলেন।
একদিন ভগবান শ্রী রামচন্দ্র ভ্রমণকালে নবদ্বীপে এসেছিলেন। সেখানে আসার পর অনেক লীলা সংবরণ করেন। তার অপার লীলা কৃপায় এই জগতের সকল জীব যেন মুগ্ধ হয়ে গেল। সেই সময় মাতা সীতাদেবীর মনে একটা প্রশ্ন জেগে উঠে। এবং তিনি শ্রী রামচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করলেন, আর্জ এই অপরূপ নবদ্বীপে এসে আপনি জগতের জন্য কি কারণ খুজছেন? আর কেনই বা আপনি এই স্থানে এলেন? সীতাদেবীর প্রশ্ন শুনে শ্রী রামচন্দ্র মৃদু হেসে বলেন, এই নবদ্বীপে আমি কৃষ্ণ নামে অবতার হয়ে কলিযুগে লীলা বিলাস করবো। আর তোমাকে আমি কাছে পেয়েও হারাবো। তারপর আমি সব কিছু ছেড়ে আমি সন্ন্যাস গ্রহণ করবো।
এই ছিল শ্রী রামচন্দ্রের লীলাখেলা যা জগতের মানুষ আজো ভক্তিভরে স্মরণ করে। এবং উনাকে অনুস্মরণ করে শিক্ষা গ্রহণ করে।
জয় ভগবান শ্রী রামচন্দ্রের জয়।