শিব হলেন (ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব) এই ত্রিশক্তির প্রধান

ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব এই ত্রিশক্তি হচ্ছে হিন্দুধর্মের মূল স্তম্ভ। শিব হলেন এই ত্রিশক্তির প্রধান।  তিনি সমসাময়িক হিন্দুধর্মের তিনটি সর্বাধিক প্রভাবশালী সম্প্রদায়ের অন্যতম দেবতা এবং শৈব সম্প্রদায়ের প্রধান দেবতা। স্মার্ত সম্প্রদায়ে পূজিত ঈশ্বরের পাঁচটি প্রধান রূপ  গণেশ, শিব, সূর্য, বিষ্ণু ও দুর্গা। শিব হচ্ছে এদের পূজিত একটি রূপ। তিনি ধ্বংস, সংহার ও প্রলয়ের দেবতা। সর্বোচ্চ স্তরে শিবকে অসীম, সর্বোৎকর্ষ, অপরিবর্তনশীল ও নিরাকার মনে করা হয়। শিবের অনেকগুলি সদাশয় ও ভয়ঙ্কর রূপ আছে। সদাশয় রূপে তিনি একজন সর্বজ্ঞ যোগী। তিনি কৈলাস পর্বতে সন্ন্যাসীর মত জীবন যাপন করেন। আবার গৃহস্থ রূপে তিনি পার্বতীর স্বামী এবং  কার্তিক ও গণেশ  তাঁদের দুই পুত্র । ভয়ঙ্কর রূপে তাঁকে প্রায়শই দৈত্যবিনাশী বলে বর্ণনা করা হয়। শিবকে যোগ, ধ্যান ও শিল্পকলার দেবতাও মনে করা হয়।

শিবের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল তাঁর তৃতীয় নয়ন, গলায় বাসুকী নাগ, জটায় অর্ধচন্দ্র, জটার উপর থেকে প্রবাহিত গঙ্গা, অস্ত্র ত্রিশূল ও বাদ্য ডমরু। শিবকে সাধারণত ‘শিবলিঙ্গ’ নামক বিমূর্ত প্রতীকে পূজা করা হয়। সমগ্র হিন্দু সমাজে শিবপূজা প্রচলিত আছে। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্রে বাংলাদেশের ও পাকিস্তানের কিছু অংশে শিবপূজার ব্যাপক প্রচলন লক্ষিত হয়।

রূপ

তৃতীয় নয়ন : শিবের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল তাঁর তৃতীয় নয়ন। এই নয়ন দ্বারা শিব কামকে ভস্ম করেছিলেন। বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে শিবের যে ত্র্যম্বকম্ (সংস্কৃত: त्र्यम्बकम्) নামটি পাওয়া যায় তার প্রকৃত অর্থ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। ধ্রুপদি সংস্কৃতে অম্বক শব্দের অর্থ চক্ষু, মহাভারতে শিবকে ত্রিনয়ন রূপে কল্পনা করা হয়েছে, তাই উক্ত নামটির আক্ষরিক অর্থ করা হয়ে থাকে “তৃতীয় নয়নধারী”।

অর্ধচন্দ্র : শিবের মস্তকে একটি অর্ধচন্দ্র বিরাজ করে। এই কারণে শিবের অপর নাম চন্দ্রশেখর (সংস্কৃত: चन्द्रशेखर)।

বিভূতি : শিব তাঁর সর্বাঙ্গে বিভূতি বা ভস্ম মাখেন। ভৈরব ইত্যাদি শিবের কয়েকটি রূপ প্রাচীন ভারতীয় শ্মশান বৈরাগ্য দর্শনের সঙ্গে যুক্ত। রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ্যবাদের সঙ্গে সম্পর্কহীন কয়েকটি গোষ্ঠী এই মত অনুযায়ী ধর্মসাধনা করেন। থেরবাথ বৌদ্ধধর্মের পালি ধর্মগ্রন্থেও এই শ্মশান সাধনার উল্লেখ রয়েছে। এই কারণে শিবের অপর নাম শ্মশানবাসী ও বিভূতিভূষণ।

জটাজুট : শিবের মস্তকের কেশরাশি জটাবদ্ধ। এই কারণে শিবের অপর নাম জটী বা কপর্দী (“কপর্দ বা কড়ির ন্যায় কেশযুক্ত”)।

নীলকণ্ঠ : একবার দেবতা আর অসুর মধ্যে যুদ্ধে অমৃত পানের জন্যে দেবতারা সমুদ্রমন্থন করছিলেন। মন্থনকালের এক পর্যায়ে সমুদ্র থেকে হলাহল বিষ উত্থিত হলে তার বিষাক্ত নির্যাষে দেবতারা অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। তখন দেবতাদের রক্ষা করার জন্য ভগবান শিব সেই বিষাক্ত বিষ পান করেন। এর ফলে উনার কন্ঠ নীল হয়ে যায়। একারনেই ভগবান শিব নীলকণ্ঠ (সংস্কৃত: नीलकण्ठ) নামে পরিচিত হন।

পবিত্র গঙ্গা : হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, গঙ্গা নদীর উৎস শিবের জটা। এই কারণে শিবের অপর নাম গঙ্গাধর।

ব্যাঘ্রচর্ম : শিবের পরিধেয় বস্ত্র ব্যাঘ্রচর্ম বা বাঘছাল। এই কারণে শিবের অপর নাম কৃত্তিবাস। শিব ব্যাঘ্রচর্মের আসনের উপর উপবিষ্টও থাকেন। উল্লেখ্য, ব্যাঘ্রচর্মের আসন ছিল প্রাচীন ভারতের ব্রহ্মর্ষিদের জন্য রক্ষিত একটি বিশেষ সম্মান।

সর্প : শিবের গলায় একটি সাপ সর্বদা শোভা পায়। এর নাম হচ্ছে বাসুকী নাগ।

ত্রিশূল : শিবের অস্ত্র হল ত্রিশূল।

ডমরু : শিবের হাতে ডমরু নামে একপ্রকার বাদ্যযন্ত্র শোভা পায়। নটরাজ নামে পরিচিত শিবে নৃত্যরত মূর্তির এটি একটি বিশিষ্ট দিক। ডমরুধারণের জন্য নির্দিষ্ট একটি মুদ্রা বা হস্তভঙ্গিমা ডমরুহস্ত নামে পরিচিত। ডমরু কাপালিক সম্প্রদায়ের প্রতীক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

নন্দী : নন্দী নামে একটি পৌরাণিক ষাঁড় শিবের বাহন। শিবকে পশুদের দেবতা মনে করা হয়। তাই তাঁর অপর নাম পশুপতি (সংস্কৃত: पशुपति)।

গণ : শিবের অনুচরদের গণ বলা হয়। এঁদের নিবাসও কৈলাস। এঁদের ভৌতিক প্রকৃতি অনুসারে ভূতগণ নামেও অভিহিত করা হয়। এঁরা সাধারণত দয়ালু। কেবল কোনো কারণে তাঁদের প্রভু ক্রুদ্ধ হলে এঁরা প্রভুর সঙ্গে ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠেন। শিব স্বীয় পুত্র গণেশকে তাঁদের নেতা মনোনীত করেন। এই কারণেই গণেশ গণপতি নামে অভিহিত হন।

কৈলাস : হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, শিবের অধিষ্ঠান হিমালয়ের কৈলাস পর্বতে। হিন্দুপুরাণ অনুসারে, লিঙ্গাকার কৈলাস পর্বত মহাবিশ্বের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত।

বারাণসী : বারাণসী শিবের প্রিয় নগরী। এই নগরী হিন্দুদের পবিত্রতম তীর্থগুলির অন্যতম। হিন্দু ধর্মগ্রন্থে এই নগরী কাশীধাম নামে পরিচিত।

শিবলিঙ্গ

শিবলিঙ্গ (সংস্কৃত: लिङ्गं, লিঙ্গ; অর্থাৎ, “প্রতীক” বা “চিহ্ন” ) হল হিন্দু দেবতা শিবের একটি প্রতীকচিহ্ন। ধ্যানমগ্ন শিবকে এই প্রতীকের সাহায্যে প্রকাশ করা হয় , হিন্দু মন্দিরগুলিতে সাধারণত শিবলিঙ্গে শিবের পূজা হয়। শিব ব্রহ্মের ধ্যানে লীন থাকেন। আর সব মানুষকেও ব্রহ্মের প্রতি ধ্যানমগ্ন হতে উপদেশ দেন। লিঙ্গ শব্দটির উৎপত্তি সৎস্কৃত লিঙ্গম্ শব্দ থেকে যার অর্থ প্রতীক বা চিহ্ন। বাংলায় এই শব্দটি ব্যাকরণ শাস্ত্রে কোনো ব্যক্তি বা বস্তু পুরুষ নাকি স্ত্রী নাকি ক্লীব প্রভৃতি চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হয়। শিবলিঙ্গ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো শিবের মাথা। তবে অজ্ঞতাবশত লিঙ্গ শব্দটি তার অর্থ পরিবর্তন করে বাংলায় পুরুষ জননেন্দ্রিয় অর্থ লাভ করেছে যা বিকৃত এবং অশালীন, এক্ষেত্রে এটি বাংলায় শিশ্ন শব্দকে প্রতিস্থাপিত করেছে। যা হোক শিব লিঙ্গের উপরে ৩টি সাদা দাগ থাকে যা শিবের কপালে থাকে। তাই শিবলিঙ্গ যদি কোন জনেন্দ্রিয় বুঝাত তাহলে শিবলিঙ্গের উপরে ঐ ৩টি সাদা তিলক রেখা থাকত না। শিবলিঙ্গ ৩টি অংশ নিয়ে গঠিত, সবার নিচের অংশকে বলা হয় ব্রহ্ম পিঠ, মাঝখানের অংশ বিষ্ণুপিঠ এবং সবার উপরের অংশ শিব পিঠ । একটি সাধারণ তত্ত্ব অনুযায়ী, শিবলিঙ্গ শিবের আদি-অন্তহীন সত্ত্বার প্রতীক এক আদি ও অন্তহীন স্তম্ভের রূপবিশেষ।

পঞ্চমন্ত্র

শিবের পবিত্র সংখ্যা হল পাঁচ। তাঁর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রগুলির একটি (নমঃ শিবায়) পাঁচটি অক্ষর দ্বারা গঠিত। কথিত আছে, শিবের শরীর পাঁচটি মন্ত্র দ্বারা গঠিত। এগুলিকে বলা হয় পঞ্চব্রহ্মণ। দেবতা রূপে এই পাঁচটি মন্ত্রের নিজস্ব নাম ও মূর্তিতত্ত্ব বর্তমান:
* সদ্যোজাত
* বামদেব
* অঘোর
* তৎপুরুষ
* ঈশান
শিবের মূর্তি এই পাঁচটি রূপ পঞ্চাননের আকারে কল্পিত হয়। বিভিন্ন শাস্ত্রে এই পাঁচটি রূপ পঞ্চভূত, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

শিবের বিভিন্ন নাম

শিবকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়ে থাকে ৷ অন্য সকল দেবতার মত তারও ১০৮ নাম রয়েছে ৷ এর মধ্যে অন্যতম হল – মহাদেব, শিব, নটরাজ, শম্ভু, পশুপতি, নীলকন্ঠ, চিন্তামণি, মহেশ্বর, সতীপতি, ত্রিপুরারি, তীর্থরাজ, যোগীশ্বর ইত্যাদি ৷

শিবের পুত্র

হিন্দু মাত্রেই জানেন শিবের পুত্রের সংখ্যা দুই। কার্তিক বা ষড়ানন আর গণেশ বা গজানন। কিন্তু, ‘শিবপুরাণ’ জানাচ্ছে, শিবের মোট পুত্রসংখ্যা ৬। এই পুত্রেরা কেউই কিন্তু পার্বতীর সন্তান নন। শিবের বিভিন্ন লীলার সময়ে তাঁদের জন্ম হয়েছিল। কার্তিক-গণেশ ছাড়াও বাকি চার পুত্রের সন্ধান রইল এখানে।

• অয়প্প— অসুরদের হাত থেকে অমৃতকে বাঁচানোর জন্য বিষ্ণু মোহিনীরূপ ধারণ করেন। সেই সময়ে শিব তাঁর সঙ্গে মিলিত হন এবং এই মিলনের ফলেই অয়প্পর জন্ম হয়। দক্ষিণ ভারেত অয়প্পকে গুরুত্বপূর্ণ দেবতা বলেই মনে করা হয়। তাঁকে হরি ও হরের সম্মিলিত রূপ বলে মনে করা হয়।

• অন্ধক— দানবরাজ হিরণ্যাক্ষ পুত্রহীন ছিলেন। তিনি পুত্রলাভের আশায় মহাদেবের তপস্যা করেন। শিব তাঁকে এক পুত্রসন্তান প্রদান করেন। জন্মান্ধ সেই পুত্রের নাম ছিল অন্ধক। পরে অন্ধক পার্বতীকে ধর্ষণ করতে চাইলে স্বয়ং শিবই তাঁকে হত্যা করেন।

• ভৌম— শিবের স্বেদবিন্দু ভূমিতে পড়েই ভৌমের জন্ম হয়েছিল। শিব তখন গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। ভূমিদেবীই ভৌমকে পালন করেন। পরে শিব ভৌমের কথা জানতে পারেন এবং তাঁকে পুত্র হিসেবে স্বীকার করে নেন।

• খুজ— একবার গভীর ধ্যানে মগ্ন অবস্থায় শিবের দেহ থেকে তীব্র জ্যোতি বিকীর্ণ হতে থাকে। সেই জ্যোতি ভূমিতে প্রবিষ্ট হলে খুজের জন্ম হয়। তাঁকে লৌহের দেবতা বলে মনে করা হয়।

উৎসব

প্রতি বছর হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশী তিথিতে শিবরাত্রি উৎসব উদযাপিত হয়। এই উৎসব হিন্দুদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই দিন ভক্তের শিবের মস্তকে ফল, ফুল ও বিল্বপত্র অর্পণ করে। চৈত্রসংক্রান্তির দিন বাংলায় শিবকেন্দ্রিক একটি বিশেষ উৎসব পালিত হয়। এটি চড়ক উৎসব নামে পরিচিত। এটি পৌরাণিক উৎসব নয়, লোকউৎসব। গাজন এই উৎসবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

তথ্য সূত্র : উইকিপিডিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published.