বিশ্বকর্মা
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী বিশ্বকর্মা দেবতাদের শিল্পী। তিনি সবার কাছে দেবশিল্পী নামে পরিচিত। বিষ্ণুপুরাণ মতে যোগসিদ্ধা বিশ্বকর্মার মাতা এবং অষ্টম বসু প্রভাস তাঁর পিতা। যোগসিদ্ধা হচ্ছেন দেবগুরু বৃহস্পতির ভগিনী। অষ্টম বসু প্রভাস হচ্ছেন ধর্মের ঔরসে দক্ষরাজার কন্যা বসুর্যার গর্ভের সন্তান। অষ্টবসু মানে আট জন গণ দেবতা। তাঁরা হলেন – ধর, ধ্রুব, সোম, অনিল, অনল, প্রত্যুষ, প্রভাষ ও দ্যু। এই অষ্টবসু দক্ষরাজার কন্যা বসুর্যার পুত্র। বিশ্বকর্মার বাহন হাতি। বিশ্বকর্মা শুধু দেবশিল্পী নন, তিনি মর্ত্যবাসী মানবদেরও শিল্প প্রজাপতি। স্বর্গের অনান্য দেবতাদের মতো এই মর্ত্যলোকে তাঁরও পূজা হয়। তাঁর আশীর্বাদে মর্ত্যবাসীগণ শিল্পকাজে যথেষ্ট পারদর্শী হয়েছেন।

বিশ্বকর্মার ধ্যান মন্ত্র :
ওঁ বিশ্বকর্মন্ মহাভাগ সুচিত্রকর্মকারক্ ।
বিশ্বকৃৎ বিশ্বধৃক্ ত্বঞ্চ রসনামানদণ্ডধৃক্ ।।
অর্থ- হে দংশপাল ( বর্মের দ্বারা পালনকারী ) , হে মহাবীর , হে বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও বিশ্ব বিধাতা, হে সুন্দর চিত্র রূপ কর্মকারক , আপনি মাল্য চন্দন ধারন করে থাকেন ।
বিশ্বকর্মার প্রনাম মন্ত্র:
দেবশিল্পি মহাভাগ দেবানাং কার্য্যসাধক ।
বিশ্বকর্মন্নমস্তুভ্যং সর্বাভীষ্টপ্রদয়ক ।।
অর্থ- দেবশিল্পী , মহাভাগ ( দয়াদি অষ্ট গুন যুক্ত ) দেবতা দের কারু কার্য্যসাধক সর্বাভীষ্ট প্রদানকারী হে বিশ্বকর্মা আপনাকে নমস্কার ।
ধ্যান ও প্রনাম মন্ত্রে বিশ্বকর্মার যে পরিচয় পাওয়া গেলো- সেটি হল বিশ্বকর্মা মহাবীর আবার দয়াদি অষ্ট গুন যুক্ত। তিনি সৃষ্টি কর্তা আবার সৃষ্টি বিধাতা। তিনি মহাশিল্পী আবার মহাযোদ্ধা।
বিশ্বকর্মার সৃষ্টি তত্ব
ঋকবেদে বিশ্বকর্মাকে সর্বদর্শী ভগবান হিসাবে উল্লেখ আছে। তাঁর চক্ষু, মুখমণ্ডল, বাহু ও পদদ্বয় সর্বদিক ব্যাপিয়া রয়েছে। বাহু ও পদদ্বয়ের সাহায্যে তিনি স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল অর্থাৎ ত্রিভুবন নির্মাণ করেছেন। তিনি শিল্প সমূহের প্রকাশক, অলঙ্কারের স্রষ্টা এবং দেবতাদের বিমান ও রথ নির্মাতা। দেবতাদের সকল অস্ত্র তাঁরই নির্মিত। মহাভারত মতে তিনি শিল্পের শ্রেষ্ঠকর্তা, সহস্র শিল্পের আবিষ্কারক। দেবতাদের পুষ্পক রথের নির্মাতা, অস্ত্রশস্ত্রের স্রষ্টা, শ্রীবিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিবের ত্রিশূল, লক্ষ্মীর কোষাধ্যক্ষ কুবেরের কুবের পাস, কার্তিক বল, লঙ্কা নগরী, পঞ্চপান্ডবের ইন্দ্রপ্রস্থ নগরী তৈরি এবং শ্রী ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ জগন্নাথের বিগ্রহ নির্মাতা । তিনি সহস্র শিল্প বিদ্যার অধিকারী যবিষ্ঠ বা অগ্নিরূপে কথিত। নল নামধারী বানর বিশ্বকর্মার পুত্র। ত্রেতাযুগের অবতার রামচন্দ্র সমুদ্রের সেতুবন্ধ নির্মাণকালে বিশ্বকর্মা নল বানরকে সৃষ্টি করেছিলেন। উপবেদ, স্থাপত্যবেদ এর রচয়িতা এবং চতুঃষষ্ঠী কলার অধিষ্ঠাতা হচ্ছেন বিশ্বকর্মা।
তিনি ধাতা, বিশ্বদ্রষ্টা ও প্রজাপতি। তিনি পিতা, সর্বজ্ঞ দেবতাদের নামদাতা এবং মর্ত্যজীবের অনধিগম্য। বিশ্বকর্মা সর্বমেধ যজ্ঞে নিজেকে নিজের কাছে বলি দিয়েছেন। তিনি বাচস্পতি, মনোজব, বদান্য, কল্যাণ কর্মা ও বিধাতা। কোন এক পুরাণ মতে, বিশ্বকর্মা বৈদিক ত্বষ্টা দেবতাদের কর্মশক্তিও আত্মসাৎ করেছিলেন। এইজন্য তিনি ত্বষ্টা নামেও অভিহিত। বৈদিক দেবতা ত্বষ্টার বিভিন্ন গুণ ছিল। ত্বষ্টা, বিশ্বকর্মা এবং বিস্মৃতনামা হরপ্পীয় শিল্প দেবতা একাকার হয়ে মিলেমিশে গিয়েছে।
বিশ্বকর্মার কন্যা সজ্ঞাকে সূর্য্যের সঙ্গে বিবাহ দেন। সজ্ঞা সূর্য্যের প্রখর তাপ সহ্য করতে পাছিলেন না, তাই বিশ্বকর্মা শান চক্র স্থাপন করে সূর্যের উজ্জ্বলতার এক অষ্টমাংশ কর্তন করেন। এই কর্তিত অংশ পৃথিবীর ওপর পতিত হলে উক্ত অংশের দ্বারা বিশ্বকর্মা দেবতাদের জন্য বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করেন।
বিশ্বকর্মার মূর্তি তত্ব
বিশ্বকর্মার মূর্তি চতুর্ভুজা । তাঁর বাহন হাতি উপর বসে থাকেন। তাঁর এক হাতে দাঁড়িপাল্লা, অন্য হাতে হাতুরী, ছেনী ( লম্বা , ভারী লোহার যন্ত্র, ফুটো করার কাজে ব্যবহার হয় ) , কুঠার থাকে । অবশ্যই এগুলি শিল্পের প্রয়োজনীয় জিনিষ, তাই শিল্প দেবতা বিশ্বকর্মা এগুলি ধারন করে থাকেন ।
বিশ্বকর্মার পূজা
বিশ্বকর্মা পূজা ভাদ্র সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য দেব-দেবীর মতোই মূর্তি গড়ে অথবা ঘটে-পটে বিশ্বকর্মার পূজা করা হয়। এই সময় বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিকেরা মহা আড়ম্বরে বিশ্বকর্মার পূজা করে থাকেন। সূতার-মিস্ত্রিদের মধ্যে এঁর পূজার প্রচলন সর্বাধিক এছাড়াও স্বর্ণকার, কর্মকার , দারুশিল্প, স্থাপত্যশিল্প, মৃৎশিল্প প্রভৃতি শিল্পকর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিগণও নিজ নিজ কর্মে দক্ষতা অর্জনের জন্য বিশ্বকর্মার পূজা করে থাকেন। বিশ্বকর্মা শুধু শ্রমিকের নয়, কৃষকদেরও উপাস্য দেবতা। ভাদ্র মাসের শেষের দিকে কৃষি কর্মের পূর্ণতা হয় এবং তখন কৃষকেরা ফসলের জন্য প্রতিক্ষা করেন। তাই সেই কর্ম ক্ষান্তিতে অর্থাৎ ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে তাঁকে পূজা করে কৃষকেরা কৃতজ্ঞতা নিবেদন করেন। এই সময় প্রত্যেকের ঘরে বিশেষ খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় এবং কোথাও কোথাও পূজার পরে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবের আয়োজন করা হয়।
তথ্য সূত্র : উইকিপিডিয়া